বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আশঙ্খা
- আপডেট সময় : ০৪:২১:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪ ২০৮ বার পড়া হয়েছে
জাতীয় রাজস্ববোর্ড এন.বিআর সম্প্রতি এক প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থনেতিক অঞ্চলে দেয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছেন। সুবিধাগুলো ছিল ,দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করলে ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা মিলবে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি পাওয়া যাবে। সরকারের কাছ থেকে এ রকম বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শুরু বিনিয়োগ করেন। কিন্তু এনবি আর এর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বিরক্ত বিদেশী বিনিযোগকারীগণ । সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে দেশি-বিদেশি অন্তত ৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ শঙ্কায় পড়বে। খোদ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই এ আভাস পাওয়া গেছে। তাঁরা বলেন, উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবেন কি না, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সুবিধা প্রত্যাহারের সমালোচনা করেছে।
বেজার কর্মকর্তারা বলেন, সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশে আর বিনিয়োগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই আশঙ্কায় দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রায় ১৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যেতে পারে। একই চিত্র সিটি গ্রুপেও। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আসা কয়েকটি কোম্পানির মালিকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সুবিধাগুলো না থাকলে তাঁরা এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত অনেকটা ‘গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার’ মতো। এতে দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যাবে। পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ আসার পথও রুদ্ধ হবে। তাঁরা বলেন, শিল্পায়নের জন্য দরকার নীতির ধারাবাহিকতা। সেটি না থাকলে কেউ বিনিয়োগে আস্থা পাবেন না।
বেসরকারি সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কর বাবদ কিছু বাড়তি টাকা পেতে সরকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে দেখা করেছেন উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুনও এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সংগঠন বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে। এদিকে আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সরকারের শীর্ষ মহলে এ নিয়ে আলোচনা ও নতুন সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চেয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। এ জন্য সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া শুল্ক অব্যাহতির অপব্যবহার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছু খাতে দুই বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কর অব্যাহতি কমিয়ে আসছে এনবিআর।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে।
অন্যদিকে বেজার তথ্য হচ্ছে, গত তিন বছরে এসব সুবিধা দেওয়ায় সরকার ৫০০ কোটি টাকার কম রাজস্ব হারিয়েছে।
গত ২৯ মে এক প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানায় এনবিআর। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে এত দিন শুল্ক অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা ছিল। প্রস্তাবিত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়।
এত দিন সব ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এবার সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর আয়কর আরোপ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা পণ্য আমদানিতেও এত বছর শুল্ক অব্যাহতি ছিল। সে ক্ষেত্রে নতুন বাজেটে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইজেডে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে এত দিন দেওয়া বন্ড সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়োজিত বিদেশি কর্মীদের প্রথম তিন বছরের আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর অব্যাহতি ছিল। সেটি বাতিল করা হয়েছে।
বেজার কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এনবিআর ইজেডের সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে এনবিআর দুটি আইন ভঙ্গ করেছে। প্রথমত, কাস্টমস আইনের ২৬২ নম্বর ধারায় বলা আছে, আইন ও বিধি বাস্তবায়ন–সম্পর্কিত বিষয়ে সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি খাতের কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ নেবে। দ্বিতীয়ত, ইজেডে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীদের কী কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা বেজার আইনের ১০, ১১ ও ১৩ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে।
জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন গতকাল তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো নীতির ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। নতুন সিদ্ধান্তে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশিরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অনেক দেশীয় উদ্যোক্তার মধ্যেও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে।