ঢাকা ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২৩ জুন পলাশীর পরাজয় ইতিহাসের কালো অধ্যায়

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:৩৮:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুন ২০২১ ২১২ বার পড়া হয়েছে
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
যে জাতি তার ইতিহাস জানে না বা জানতে চায় না, তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। আমরা সবাই বলি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন দু:খজনক হলেও সত্য কেউ আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। আমাদের সবারই পলাশী থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। পলাশীর ট্র্যাজেডির জন্য যতটা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি দায়ী ঠিক ততটাই নবাবের কাছের লোকেরাও দায়ী।
২৩ ই জুন, ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস। ১৭৭ সালের ২৩ ই জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব নবাব সিরাজ উদ্দৌলা বনাম ইংরেজিদের যুদ্ধ যুদ্ধ নাটকের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। সেদিন স্বাধীনতার যে সূর্য্য অস্ত গিয়েছিল তার আবার ফিরে পেতে ২০০ বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। পলাশীর প্রান্তে নবাবের পরাজয় আমাদের গোটা জাতির জন্য বিরাট বড় শিক্ষা। হতাশাজনক হলেও সত্য, পলাশী যুদ্ধের পরাজয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আজও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি বা পারছিও না। মীর জাফর, উর্মিচাঁদ ও রবার্ট ক্লাইভের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যু হলেও আজও তাদের প্রেতাত্মা এ বাংলার কিছু মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্তে পলাশীর প্রান্তরে ২০০ বছরের জন্য বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। এক ঘণ্টার যুদ্ধ নামক প্রহসনে পরাজয় ঘটে বাংলা, বিহার ও ওরিস্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার। পলাশীর ২৩ জুনের ইতিহাস প্রকৃত সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস, বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস। সে দিন কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নাই। নবাব বুঝতে পেরেছিলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে আর করার কিছু ছিল না নবাবের।
নবাবের নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের অধিকাংশ সৈন্য সেদিন নিরব দর্শকের মতো নবাবের পরাজয়কে দেখেছিলো। বাংলার তরুণ নবাব নিজের জীবন দিয়েও বাংলার স্বাধীনতাকে সেদিন রক্ষা করতে পারেননি। উপনিবেশিক ইংরেজি শক্তির অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভে সেদিন অন্ধ হয়ে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিলো বিশ্বাসঘাতকেরা। সেদিন নবাবের সভাসদ ও সেনাপতিরা তারা সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে আজকে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক শক্তির পরাজয় নয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় পলাশীর যুদ্ধে চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে :
“কান্ডারী!তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।”
পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘সেদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি।’
পলাশী যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন বাবের পরাজিত হওয়ার মূল কারণ কী? তা সঠিকভাবে আজও আমরা উপলব্ধি করতে পারি নাই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই যে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩ হাজার ২০০ সৈন্যের কাছে সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যের অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার একটা দেশের হাজারো সৈন্য পরবর্তী সময়ে কোথায় গেল?
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ইতিহাসের ভিলেন শুধু যেন মনে হয় মুসলমান মীরজাফরের কথা, যেন প্রমাণ হয় মুসলমান জাতি মানেই বিশ্বাসঘাতক জাতি। তাই আজ মুর্শিদাবাদ জেলা ও মুসলমান জাতি পর্যন্ত বাংলার বাতাসে যেন কলঙ্ক, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস এই কথাই বলে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতার আকাশ ধোঁয়া অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল তা মুসলমানদের হাতেই। সিপাহি বিদ্রোহ তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণ। আজ যেমন মীরজাফর ও ঘষেটি বেগমের কথা বারবার করে বলা হয়, তেমন জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদদের কথা কেন বারবার বলা হয় না ? এ প্রশ্নটি আজ সবার মনে। ইংরেজরা যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পিঞ্জিরাবন্ধি পাখির মতো বন্দি করেছিল তখন সিরাজের সমস্ত চাকর-চাকরানী আর নবাবের ছিল না বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ক্লাইভ আর ওয়াটসেনর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিল।
এমতাবস্থায় ইতিহাসে মুসলিম চরিত্রকে কলঙ্কিত করার পরিকল্পিত বুদ্ধিতেই নবাবের সাহায্যপুষ্ট মোহাম্মদী বেগকেই আদেশ করা হয়েছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করতে। মোহাম্মদী বেগ তাতে রাজি না হওয়ায় তারও প্রাণদন্ড দেয়া হবে বলে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। তখন অনন্য উপায় নিরক্ষর-বোকা মোহাম্মদী বেগ অশ্রু সংবরণ করেও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। যদি মহম্মদী বেগ শিক্ষিত জ্ঞানী হতো তাহলে ইংরেজদের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে নিজের প্রাণদন্ডকেই অমৃত জ্ঞানে বরণ করে মীর মদন আর মোহন লালের মতো ধন্য হতে পারত। নবাব যখন একটু অসহায়ের মতো বেঁচে থাকার আবেদন করেছিল তখন মহম্মদ বেগ একথা বলেনি যে, আমরা তা দেব না। বরং তার ভাষাতে হৃদয়ের অবধারিত প্রেমধারাই প্রবাহিত হয়েছিল, ‘না তাঁরা তা দেবে না’। এই তারা কারা?
যেকোনো কারণেই হোক সেদিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল। পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষিকাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কী নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল, কয়েক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল গোটা কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের টনক নড়ল না। টনক যখন নড়ল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না। সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে একমাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।
২৩ জুন আমাদের জাতীয় জীবনে শুধু একটি কলঙ্কেরই দিন নয়, এই দিনটি শিক্ষণীয় দিবসও বটে। বাংলার ইতিহাসে এই পলাশী অধ্যায় যেমন ন্যক্কারজনক হৃদয়বিদারক ঘটনা, তেমনি আমাদের জাতীয় জীবনে এর মাশুল দিতে হয়েছে দীর্ঘ ২০০ বছর। পলাশীর শিক্ষা হলো স্বাধীনতা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। দেশপ্রেম দেশের সবচেয়ে বড় আমানত। এই সত্যটা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিককে আমাদের সর্বদাই উবলব্ধি করতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে।
মনে রাখতে হবে, পলাশীর পতন ছিলো একটি জাতিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হবার পর বিদেশি ও দেশীয় বেনিয়াদের যোগসাজশে যে লুটপাটের রাজত্ব শুরু হয়, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতন কোনো একক ব্যক্তির পতন ছিলো না, এটি ছিলো একটি স্বাধীন জাতির পতন। মুর্শিদাবাদের পলাশীর প্রান্তরে কোনো যুদ্ধ হয়নি, হয়েছিলো যুদ্ধের নামে প্রহসন। পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো শুধুমাত্র সিরাজ-উদ-দৌলার মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদের সীমাহীন লোভ-দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন। পলাশীর বিপর্যয় তখনই ঘটেছিলো যখন অর্থনীতির ওপর থেকে তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে গিয়েছিলো। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে দেশ পলাশীর দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
২৩ জুন বার বার আমাদের এই সতর্কবাণী শুনিয়ে যায়, দেশের আভ্যন্তরিন শত্রুরা বর্হি শত্রুর চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর। আজ প্রশ্ন জাগে আমরা কি ২৩ জুনের কালো অধ্যায় থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি ? আমাদেরকে অর্জন করতে হবে জাতীয় ঐক্যের শক্তি। নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদকে ভুলে দেশের জন্য কাজ করতে হবে আমাদের। প্রিয় জন্মভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের থেকে মুক্ত রাখতে হলে সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক নাগরিক গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। পলাশীর যুদ্ধের পতনের কারণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
[ লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

২৩ জুন পলাশীর পরাজয় ইতিহাসের কালো অধ্যায়

আপডেট সময় : ১২:৩৮:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুন ২০২১
যে জাতি তার ইতিহাস জানে না বা জানতে চায় না, তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। আমরা সবাই বলি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন দু:খজনক হলেও সত্য কেউ আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। আমাদের সবারই পলাশী থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। পলাশীর ট্র্যাজেডির জন্য যতটা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি দায়ী ঠিক ততটাই নবাবের কাছের লোকেরাও দায়ী।
২৩ ই জুন, ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস। ১৭৭ সালের ২৩ ই জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব নবাব সিরাজ উদ্দৌলা বনাম ইংরেজিদের যুদ্ধ যুদ্ধ নাটকের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। সেদিন স্বাধীনতার যে সূর্য্য অস্ত গিয়েছিল তার আবার ফিরে পেতে ২০০ বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। পলাশীর প্রান্তে নবাবের পরাজয় আমাদের গোটা জাতির জন্য বিরাট বড় শিক্ষা। হতাশাজনক হলেও সত্য, পলাশী যুদ্ধের পরাজয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আজও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি বা পারছিও না। মীর জাফর, উর্মিচাঁদ ও রবার্ট ক্লাইভের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যু হলেও আজও তাদের প্রেতাত্মা এ বাংলার কিছু মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্তে পলাশীর প্রান্তরে ২০০ বছরের জন্য বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। এক ঘণ্টার যুদ্ধ নামক প্রহসনে পরাজয় ঘটে বাংলা, বিহার ও ওরিস্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার। পলাশীর ২৩ জুনের ইতিহাস প্রকৃত সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস, বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস। সে দিন কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নাই। নবাব বুঝতে পেরেছিলেন, সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে আর করার কিছু ছিল না নবাবের।
নবাবের নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের অধিকাংশ সৈন্য সেদিন নিরব দর্শকের মতো নবাবের পরাজয়কে দেখেছিলো। বাংলার তরুণ নবাব নিজের জীবন দিয়েও বাংলার স্বাধীনতাকে সেদিন রক্ষা করতে পারেননি। উপনিবেশিক ইংরেজি শক্তির অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভে সেদিন অন্ধ হয়ে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিলো বিশ্বাসঘাতকেরা। সেদিন নবাবের সভাসদ ও সেনাপতিরা তারা সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে আজকে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক শক্তির পরাজয় নয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় পলাশীর যুদ্ধে চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে :
“কান্ডারী!তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।”
পলাশী যুদ্ধ সম্পর্কে রবার্ট ক্লাইভ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘সেদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি।’
পলাশী যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন বাবের পরাজিত হওয়ার মূল কারণ কী? তা সঠিকভাবে আজও আমরা উপলব্ধি করতে পারি নাই। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই যে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩ হাজার ২০০ সৈন্যের কাছে সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজার সৈন্যের অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার একটা দেশের হাজারো সৈন্য পরবর্তী সময়ে কোথায় গেল?
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার ইতিহাসের ভিলেন শুধু যেন মনে হয় মুসলমান মীরজাফরের কথা, যেন প্রমাণ হয় মুসলমান জাতি মানেই বিশ্বাসঘাতক জাতি। তাই আজ মুর্শিদাবাদ জেলা ও মুসলমান জাতি পর্যন্ত বাংলার বাতাসে যেন কলঙ্ক, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস এই কথাই বলে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতার আকাশ ধোঁয়া অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল তা মুসলমানদের হাতেই। সিপাহি বিদ্রোহ তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণ। আজ যেমন মীরজাফর ও ঘষেটি বেগমের কথা বারবার করে বলা হয়, তেমন জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদদের কথা কেন বারবার বলা হয় না ? এ প্রশ্নটি আজ সবার মনে। ইংরেজরা যখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পিঞ্জিরাবন্ধি পাখির মতো বন্দি করেছিল তখন সিরাজের সমস্ত চাকর-চাকরানী আর নবাবের ছিল না বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ক্লাইভ আর ওয়াটসেনর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিল।
এমতাবস্থায় ইতিহাসে মুসলিম চরিত্রকে কলঙ্কিত করার পরিকল্পিত বুদ্ধিতেই নবাবের সাহায্যপুষ্ট মোহাম্মদী বেগকেই আদেশ করা হয়েছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করতে। মোহাম্মদী বেগ তাতে রাজি না হওয়ায় তারও প্রাণদন্ড দেয়া হবে বলে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। তখন অনন্য উপায় নিরক্ষর-বোকা মোহাম্মদী বেগ অশ্রু সংবরণ করেও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। যদি মহম্মদী বেগ শিক্ষিত জ্ঞানী হতো তাহলে ইংরেজদের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে নিজের প্রাণদন্ডকেই অমৃত জ্ঞানে বরণ করে মীর মদন আর মোহন লালের মতো ধন্য হতে পারত। নবাব যখন একটু অসহায়ের মতো বেঁচে থাকার আবেদন করেছিল তখন মহম্মদ বেগ একথা বলেনি যে, আমরা তা দেব না। বরং তার ভাষাতে হৃদয়ের অবধারিত প্রেমধারাই প্রবাহিত হয়েছিল, ‘না তাঁরা তা দেবে না’। এই তারা কারা?
যেকোনো কারণেই হোক সেদিন বাংলার মানুষ এগিয়ে যায়নি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল। পলাশীর ট্র্যাজেডির পরেও বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ দৈনন্দিন জীবন, নিত্যদিনের মতোই মাঠে কৃষিকাজ করেছে। ফসল বুনেছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধে গোটা জাতীয় জীবনে কী নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটল, কয়েক ঘণ্টার প্রহসন যুদ্ধে গোটা জাতির স্বাধীনতা হরণ করে নিয়ে গেল গোটা কয়েক বেনিয়া ইংরেজ অথচ তাদের টনক নড়ল না। টনক যখন নড়ল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের আর তখন কিছুই করার ছিল না। সিরাজউদ্দৌলা কখনো তার দেশের প্রজাদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে একমাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, বাংলার স্বাধীনতার শেষ প্রতীক।
২৩ জুন আমাদের জাতীয় জীবনে শুধু একটি কলঙ্কেরই দিন নয়, এই দিনটি শিক্ষণীয় দিবসও বটে। বাংলার ইতিহাসে এই পলাশী অধ্যায় যেমন ন্যক্কারজনক হৃদয়বিদারক ঘটনা, তেমনি আমাদের জাতীয় জীবনে এর মাশুল দিতে হয়েছে দীর্ঘ ২০০ বছর। পলাশীর শিক্ষা হলো স্বাধীনতা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। দেশপ্রেম দেশের সবচেয়ে বড় আমানত। এই সত্যটা জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিককে আমাদের সর্বদাই উবলব্ধি করতে হবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে।
মনে রাখতে হবে, পলাশীর পতন ছিলো একটি জাতিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হবার পর বিদেশি ও দেশীয় বেনিয়াদের যোগসাজশে যে লুটপাটের রাজত্ব শুরু হয়, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতন কোনো একক ব্যক্তির পতন ছিলো না, এটি ছিলো একটি স্বাধীন জাতির পতন। মুর্শিদাবাদের পলাশীর প্রান্তরে কোনো যুদ্ধ হয়নি, হয়েছিলো যুদ্ধের নামে প্রহসন। পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো শুধুমাত্র সিরাজ-উদ-দৌলার মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদের সীমাহীন লোভ-দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন। পলাশীর বিপর্যয় তখনই ঘটেছিলো যখন অর্থনীতির ওপর থেকে তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে গিয়েছিলো। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে দেশ পলাশীর দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
২৩ জুন বার বার আমাদের এই সতর্কবাণী শুনিয়ে যায়, দেশের আভ্যন্তরিন শত্রুরা বর্হি শত্রুর চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর। আজ প্রশ্ন জাগে আমরা কি ২৩ জুনের কালো অধ্যায় থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি ? আমাদেরকে অর্জন করতে হবে জাতীয় ঐক্যের শক্তি। নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদকে ভুলে দেশের জন্য কাজ করতে হবে আমাদের। প্রিয় জন্মভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের থেকে মুক্ত রাখতে হলে সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক নাগরিক গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। পলাশীর যুদ্ধের পতনের কারণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
[ লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]